রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে তার অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছুবে; তার কোনো একতরফা বা ‘ওয়ান ফিটস অল’ নিয়ম নেই। শহরের আর্বান মিডেল-ক্লাস লোকেরা কাছে রাজনৈতিক দলের প্রচার, গ্রাম কিংবা মফস্বলের অর্ধ-শিক্ষিত কিংবা অক্ষরজ্ঞানহীন লোকের কাছে প্রচার কখনোই এক হবে না। আর্বান মিডেল-ক্লাসের জন্য কাজ করতে হয় ইন্টেলেকচুয়াল ও সিস্টেমেটিক জায়গা থেকে – একই এপ্রোচ প্রযোজ্য শিক্ষিত তরুণ সমাজের জন্য।
অন্যদিকে গ্রাম কিংবা মফস্বলে জনসভাই বেশি ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। আদতে বেশিরভাগ জনসভা রাজনৈতিক নেতাদের ‘গলবাজি’ -এর উপলক্ষ হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর এমন এপ্রোচ বিগত সময়গুলোতে ফল দিয়েছে এবং সামনেও বেশ ফলপ্রসূ হবে। আপনি গ্রামীণ কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনসভায় গিয়ে শুদ্ধ বাংলায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সিস্টেম, পররাষ্ট্র, পলিসি মেকিং ইত্যাদি নিয়ে যতই বুলি আওড়ান না কেন – দিনশেষে আপনার সেই অডিয়েন্স এসবে রিলেট করতে পারবে না; আর এটাই স্বাভাবিক।
গ্রামীণ, প্রত্যন্ত অঞ্চল কিংবা মফস্বলে আপনাকে জিনিসপত্রের দাম কমানো, তরুণদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা, চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন করা, রাস্তাঘাট উন্নত করা – এসবের বয়ান আওড়াতে হবে। আপনি আপনার প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষিতে ৩০-৪০% কাজ করতে পারলেও আপনার গ্রহণযোগ্য বাড়বে ও ভোটের মাঠে শক্ত অবস্থানের তৈরী হবে। যদিও এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ ও নানা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ স্থানীয় সরকারের অধীনে তবুও আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকাই এগুলো জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে শহুরে আর্বান মিডেল-ক্লাসে আপনাকে স্টাটস ও কম্পারেজন নিয়ে পৌঁছুতে হবে। আর্বান মিডেল ক্লাসের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান খুব স্টাটিসটিক্যালি হাজির করতে হবে। পাশাপাশি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অসাড়তার জায়গা চিহ্নিত করে – তুলনামূলক বেটার সলিউশন হাজির করতে হবে। এখানে জনসভার থেকে কার্যকরী হবে সেমিনার, লিফলেট, বিলবোর্ড, টকশো, সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন ইত্যাদি । এখানটাই মূল ফোকাস থাকে সিস্টেম রিফর্মেশনে।
এখন প্রশ্ন অনেকের জানা এসব প্রসঙ্গ কেন তুললাম?
আমি যা বুঝাতে চেয়েছি তা হলো, মার্কেটিং এর মতো রাজনৈতিক গুলো কীভাবে বা কোন এপ্রোচে জনগণের কাছে পৌঁছুবে, জনগণকে কীভাবে তাদের মতাদর্শ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতিতে কনভিন্স করবে এসব ম্যাটার করে। অনেক সময় দেখা যায় ছোট রাজনৈতিক দলগুলো ভালো এজেন্ডা থাকলেও পর্যাপ্ত জনসম্পৃক্ততার অভাবে তারা সেভাবে তাদের মতাদর্শ প্রচার করতে পারে না। এমনকি হাসিনার আমলে বিগত ১৭ বছরে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দল যেমন; বিএনপি, জামাতের তেমন কোনো কর্মসূচি দেখিনি যেটি সেভাবে জনগণকে আন্দোলিত করতে পেরেছে। তবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগের জুলুম নির্যাচনের বাইরে অন্যান্য বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের আস্থার অভাবও হাসিনার স্বৈরশাসনের জন্য দায়ী। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ জনগণের জোড়ালো কন্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারেনি।
কিন্তু আমরা যদি জুলাই-আগষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের কর্মসূচি গুলো খেয়াল করি তাহলে বুঝতে পারি প্রত্যেকটা কর্মসূচিই ছিলো বেশ ‘অডিয়েন্স সেন্ট্রিক’; নাম থেকে শুরু করে ফাইনাল আউটপুট। আর সব থেকে সিগনিফিকেন্ট পার্ট হলো, আন্দোলটি কখনোই স্মিত হয়ে যায়নি। বিগত সময়গুলোতে ‘ঈদের পরে আন্দোলন’ কিংবা নানা অসার রাজনৈতিক কর্মসূচির গুলো থেকে জুলাই-আগষ্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যেকটি কর্মসূচি ছিলো ভিন্ন। পাশাপাশি অরাজনৈতিক তরুণ নেতৃত্বের প্রতি ছাত্র-জনতার আস্থাও ছিলো চোখে পড়ার মতো। জুলাই-আগষ্টের রাজনৈতিক ‘কেস স্টাডি’ কিংবা তাৎপর্য অল্প কথায় শেষ হবে না।
বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একদম নতুন মতাদর্শ, নতুন এজেন্ডা ও নতুন পন্থা নিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছানো। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামীলীগ ও বিএনপি ‘কে একে অপরের বিকল্প হিসেবেই দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করেছে (এরশাদের আমল ও বিগত ৩ টি সংসদ নির্বাচন বাদে) । আর ঐতিহ্যবাহী দুটি রাজনৈতিক দলের প্রচারের কিংবা জনপ্রিয়তা লাভের অন্যতম কারিগর ছিলেন দুই আইকনিক ফিগার শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমান। দুইজন নেতা-ই শহুরে উচ্চবিত্ত, মিডল ক্লাস ও গ্রামীণ জনগণের কাছে লাভ করেছিলো সীমাহীন জনপ্রিয়তা। সে জনপ্রিয়তার ফল দুই দলই অনেক দিন ধরে ভোগ করেছে।
বাংলাদেশে সর্বশেষ যে দলটি হাইপ তৈরী করেছিলো সেটি হচ্ছে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে ‘গণ অধিকার পরিষদ’। ১৮- এর কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে লাইমলাইটে আসা নুরুল হক পরবর্তীতে ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হন ও এর পরে রাজনৈতিক দল গঠন করে। তবে শুরুতে কিছুটা রেলিভেন্সি থাকলেও সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন বিতর্ক, দলাদলি, তৃণমূল শক্তিশালী না হওয়া, শহুরে আর্বান মিডেল-ক্লাসের নিকট পৌঁছুতে না পারা, অনেক বেশি আইকনিক ফিগার তৈরী করতে না পারা, ইনটেলেকচুয়াল জায়গা মজবুত না হওয়া ও আরও নানাবিধ কারণে দলটিকে এখন আর খুব বেশি রেলিভেন্ট মনে হয় না। তবে কোটা আন্দোলনের হাতেখড়ির জন্য একটি বড় ক্রেডিট নুর-রাশেদদের প্রাপ্য। ইতিহাস যার যা প্রাপ্য সেটি তাকে বুঝিয়ে দেয়, সামনেও দিবে।
এখন প্রশ্ন, ছাত্রদের নেতৃত্বে জন্ম নিতে যাওয়া নতুন রাজনৈতিক দল আসলে কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করবে? এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে? নাকি গণ অধিকার পরিষদ কিংবা জাসদের মতো অল্প সময়ে রেলিভেন্সি হারাবে?
টু আর্লি টু সে। তবুও প্রেডিক্ট করা যায়; কিছুটা হলেও!
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সব থেকে বড় ও অধিকতর জনসম্পৃক্ত আন্দোলন ছিল প্রথমে কোটা প্রথার সংস্কারের ও পরবর্তীতে জুলাই-আগস্ট ম্যাসাকারের পরে সরকার পতনের ‘এক দফা’ দাবীতে। ছাত্রদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার আপোষহীন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অসীম সাহস ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সবাইকে মোহিত করেছিলো। উঠে এসেছে নাহিদ, আসিফ, হাসনাত, সার্জিস, হান্নান, মাসউদ, মাহফুজসহ আরও অনেকের নাম যারা গণ- অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার গঠন ও সরকারের বাইরেও তাদের নানা কাজকর্মের মাধ্যমে রেলিভেন্সি ধরে রেখেছে। সরকারের বাইরে যারা আছেন তারা গড়ে তুলেছেন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ তো আগেই থেকেই ছিলো। অভ্যুত্থান পরবর্তীতে সংগঠনটি সাংগঠনিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়েছে।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এ’মাসের শেষের দিকেই নতুন দলের ঘোষণা আসছে। সরকার থাকাকালীন রাজনৈতিক দল কিংবা ‘কিংস পার্টি’ গঠনের নজীর৷ জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় জাতীয় পার্টি তৈরী হয়। অনেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে আসা নতুন দলকে নব্য কিংস পার্টি হিসেবে আখ্যা দিতে চাইলেও বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয় এবং এটি কিংস পার্টি না হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি। ইতিমধ্যে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সরকার থেকে পদত্যাগ করে নতুন দলের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। যাই হোক।
আইকনিক নেতৃত্বের বিষয়ে আবার ফিরে আসলে নতুন দলের ক্ষেত্রে এর কোনো কমতি হবে না; জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের কথা বিবেচনায়। নতুন দলে খুব সম্ভবত জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচিত মুখগুলো নেতৃত্বের স্থানে আসবে। সর্বোপরি বলা যায়, একদল ফ্রেশ-ফেস, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে যারা রাজনীতিতে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে,তাদের মাধ্যমে আসা দলের অন্তত ‘ইমেজ’ সংকটে পরতে হবে না, অন্তত প্রাথমিকভাবে। পাশাপাশি ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ চিন্তা মার্কেটে একটি পসিটিভ পরিবর্তন আনতে পারে যেহেতু জনগণ বিগত সময়গুলোতে আওয়ামিলীগ ও বিএনপি’কে দেশ পরিচালনার জন্য বৈকল্পিক শক্তি হিসেবে নির্বাচিত করে আশাহত হয়েছেন।
চলবে……..